২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি / বিকাল ৩:২০

পদ্মা সেতুতে ভূমিকম্প রোধে যে প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে

স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দুয়ার খুলতে বাকি আর কিছু সময়। শনিবার (২৫ জুন) সেতু উদ্বোধনের জন্য ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে মিলিত হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। এরই মধ্যে উদ্বোধনের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।

পদ্মা আমাজনের পর পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা নদী। বিশ্বের এই বৃহত্তম ডেল্টার মাঝামাঝি এসে বিশাল যমুনা মিশেছে প্রমত্তা পদ্মার সঙ্গে। তৈরি করেছে স্রোতস্বিনী এক বিশাল জলরাশির যা দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে আলাদা করে রেখেছে এর উত্তর পূর্বে অবস্থিত রাজধানী ও প্রধান সমুদ্রবন্দর থেকে। তাই সড়কপথে যাতায়াতে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে প্রতিনিয়ত নদী পাড়ি দিতে হয়।

এ কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত করতে কোটি জনতার সময়ের দাবি ছিল পদ্মার দুই পাড়ের সেতুবন্ধন। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার পর সরকার সেতু ডিজাইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘মুনসেল এ কম জে ভি’-কে নিয়োগ দেয়। সেতু ডিজাইনের ক্ষেত্রে পদ্মা নদীর তিনটি বৈশিষ্ট্য তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। সদা পরিবর্তিত পদ্মার মূল স্রোতধারা, প্রচুর পলিবাহিত পদ্মার তলদেশে তীব্র স্রোত এবং ভাঙন পদ্মার তীর।

একটি দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে ১০০ বছরের স্থায়িত্বের জন্য পদ্মা সেতুকে ডিজাইন করা হয়েছে। সে কারণে এ সেতুতে ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বের এ যাবতকালের সর্ব দীর্ঘ পাইল। সম্পাদিত হয়েছে তীর সংরক্ষণের জন্য নদী শাসন সংক্রান্ত সর্বোচ্চ মূল্যমানের একক চুক্তি এবং ভূমিকম্প ক্ষতি রোধে ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফিকশন পেন্ডুলাম বেয়ারিং।

সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া: সংযোগ সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে প্রকল্পের বাস্তব কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড এইচসিএম-জেভি’র স্বয়ংক্রিয় কংক্রিট মিক্সিং ইউনিট ও অ্যাশফ্যাল প্ল্যান্ট ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছে মাওয়া প্রান্তে ১.৬৭ কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে ১০.৫৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের সংযোগ সড়ক। এটি মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর এবং শরীয়তপুর জেলার ওপর দিয়ে জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্ক এন-৮-এ যুক্ত হয়েছে পাশাপাশি এ প্রকল্পে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন তিনটি সার্ভিস এরিয়া। সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজের সঙ্গেই শুরু হয় সেতুর ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধান কার্যক্রম এর পাশাপাশি চলে পাইল তৈরির প্রস্তুতি। পাইল তৈরির জন্য চীন থেকে সমুদ্রপথে আনা স্টিল প্লেট গুলোকে রি-রোলিং মেশিনের সাহায্যে ৩ মিটার ব্যাসে মুড়িয়ে টিউব আকৃতি দেয়া হয়। ওয়েল্ডিংয়ের সাহায্যে এসব টিউব খণ্ডগুলোকে যুক্ত করে প্রয়োজনীয় দৈর্ঘ্যের টিউব পাইল প্রস্তুত করা হয়। নির্দিষ্টসংখ্যক টিউব পাইল প্রস্তুত হলে তা পাইল স্থাপনের নির্ধারিত স্থানে নিয়ে গাইডিং ফ্রেমের মধ্যে বসিয়ে শক্তিশালী হাতুড়ি দিয়ে তা ড্রাইভ করা হয়। কিন্তু পাইল ড্রাইভের প্রক্রিয়াটি পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সহজসাধ্য ছিল না কারণ, ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য ডিজাইনকালে বিবেচিত তথ্যের চাইতে কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্নতর পাওয়া যায়। বিস্তারিত বিশ্লেষণ শেষে তদারকি পরামর্শকরা নদীর অভ্যন্তরের ৪০টি পিলারের মধ্যে ২২টি পিলারের পাইল পুনঃডিজাইনের পরামর্শ প্রদান করেন। স্কাওয়ারিং বিবেচনায় পদ্মা সেতুতে ১২২ মিটার গভীরতায় ৩ মিটার ব্যাসের যে পাইল দেয়া হয়েছে পৃথিবীতে এত গভীরে আর কোনো পাইল নির্মিত হয়নি। ট্যামডাক্ট প্রযুক্তিও পৃথিবীতে এবারই প্রথম যা পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত হলো। পাইল ড্রাইভিং শেষ হলে পাইলের অভ্যন্তরের মাটি ও বালু সরিয়ে ১০ মিটার কংক্রিট বেজ গ্রাউটিং ও ৬০ মিটার কমপ্যাকটেড স্যান্ড ফিলিং সম্পন্ন করা হয়। পাইলের টপ সেকশন এর অভ্যন্তরে ১৫ মিটার পর্যন্ত লোহার খাঁচি বসিয়ে অতি উন্নত মানের মিক্সচার দিয়ে করা হয় কংক্রিটিং যা পিলার নির্মাণের ভিত্তি তৈরি করে। এভাবে ক্রমান্বয়ে রড বাইন্ডিং, সাটারিং ও কংক্রিটিংয়ের মাধ্যমে শেষ হয় পূর্ণাঙ্গ পিলার নির্মাণ।