২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ১৭ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি / রাত ৩:১৭

সড়কে আপনজনের লাশ, ‘চাই নিরাপদ সড়ক’ স্লোগানও আজ গুমরে কাঁদে !

অনিয়ন্ত্রিত ও অপেশাদার ড্রাইভারদের বিরুদ্ধে নেই কোন কঠোর ব্যবস্থা। সড়ক প্রশাসন, ট্রাফিক পুলিশ ও আইনের প্রতি, শ্রদ্ধাশীলতার প্রতি- আমাদের, নীতিগত অবহেলাকেই দায়ী করছে দেশবাসী। পাশাপাশি পথচারী পারাপারেও রয়েছে আমাদের সচেতনার অভাব। এবং স্কুল- কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়- পরিবার প্রত্যেকেরই স্বস্ব দায়িত্ববোধ নিয়ে- ‘‘রাস্তা পারাপার বিষয়ক কোন কর্মসূচী, প্রশিক্ষণসহ রাস্তায় চলাচলের নিয়মনীতি’’ পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে বাধ্যতামূলক করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এ দায় শুধু সড়ক ও জনপ্রসাশন আর পরিবহনের চালকের ওপর তুলে দিলে চলবে না। আমরা কতটা সচেতন ? রোজই সড়কে অকাতরে প্রাণ হারানোর মিছিল কিন্তু থেমে নেই। সড়ক দুর্ঘটনা এমন একটি বিষয়। যার সাথে পরিবহন ও যাত্রীর সম্পর্ক। চালক ও  পথচারীর সম্পর্ক। খুব সেনসেটিভ ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় দেশের যে সড়কসমূহে পরিবহন সেক্টর, যাত্রীসেবা নিয়ে বাণিজ্য করছে। সেই বাণিজ্য কেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে, কর্তৃপক্ষকে প্রথমেই যাত্রী ও পথচারীর নিরাপত্তার কথাটি মন মগজে নিয়ে আসতে হবে। আর নিরাপদ সড়কের কোন বিকল্প নেই। অসহনীয় যানজটও দিনকে দিন যেন চালকদের সড়কে আরও হিংস্র করে তুলছে। প্রত্যেক পরিবহন চালকের একটি বদঅভ্যাস আপনি দেখবেন, এরা একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে সাইড দিতে চায় না। এবং একে অপরের সাথে কে কার আগে যাবে এমন একটি খেলায় নেমে যেন গাড়ি চালাচ্ছে? তার হাত আর পায়ের ওপর যে পেছনে বসা কত শত মানুষের জীবন। আহ্, সেদিকে তাদের সিকি পরিমাণ অনুভূতি আপনি খুঁজে পাবেন না। প্রতিটি গাড়ির চালকদের প্রতি কঠোর হতে হবে। বন্ধ করতে হবে ওভারটেকিং কালচার। প্রধান ও ব্যস্ত সড়কের মাঝ বরাবর ফুটওভার ব্রীজ ব্যবহারে পথচারীদেরও কঠোর ও জরিমানার মাধ্যমে ফুটওভার ব্রীজ ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে। আসলে কি করতে হবে। কি পদক্ষেপ নিলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন লাশের প্রতিচিত্র টেলিভিশনের পর্দায় মানুষকে আর দেখতে হবে না। এই সুখকর মুহূর্তটির প্রতিক্ষাতেই নাগরিক সমাজ। সংবাদ শিরোনামে এমন কোন দিন নেই যে, সড়ক দুর্ঘটনা আর এত জন নিহত … আপনাকে ‘উহ্’ শব্দে ব্যথিত করছে না ?

যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুসারে- ২০২২ সালে ৬৭৪৯ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯৯৫১ জন নিহত হয়। আহত হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্বের বোঝা বহন করতে হচ্ছে ১২৩৫৬ জনকে। আর এ বছর তো সবে শুরু। আর এই নতুন বছরের হিসেবে যেভাবে অকাতরে সড়কে মানুষের প্রাণ ঝড়ছে, এই জানুয়ারির ১ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত টেলিভিশন নিউজ, অনলাইন নিউজ আর দৈনিক পত্রিকাগুলোই বলে দিচ্ছে; ২০২৩ সাল সড়কে মানুষ মারার আর মানুষ মরার ইতিহাসে এবছরটি ২০২২ সালকেও পেছনে ফেলবে নিশ্চিত। আর গতকাল ২৩ জানুয়ারি সড়কে প্রাণঘাতী খবরের শিরোনামগুলো কি বলে ? রাস্তায় আমাদের জীবন কতটা ঠুনকো। কতটা আমরা অসহায়। কতটা নিরাপত্তাহীন। কিন্তু এর প্রতিকার আর হয়ে ওঠে না।

একটা সড়ক দুর্ঘটনা। কারও মৃত্যু। এরপর দুদিন সড়ক অবরোধ আর সংসদে গলা ফাটানো! এরপর, সড়কে পরিবহনের চাকায় পিষ্ট লাশের মতই সব চিৎকার চেঁচামেচিও যেন অসাঢ় হয়ে যায়। কিন্তু বাকহীন ও অসহায় পরিবারগুলো, যারা আপনজন হারা ? সবার বুকের আহাজারি আর গুমট নিঃস্বাসের বাতাস সড়ক ও পরিবহন খাতের সাথে জড়িতদের একটুও যেন টলাতে পারছে না। কেন এবং কি কারণে, সেই দায়টাও যেন সাধারণ নাগরিকের অজানাই রয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর। আর সে কারণেই ২০২২ সালটিই সড়ক দুর্ঘটনা কমানো তো দুরের কথা। বছরটিই ছিলো বিগত সাত-আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যুসূচক একটি বছর ! দেশে যেই হারে- অনিয়ন্ত্রিত অনিবন্ধিত মোটর সাইকেল, রিক্সা, সিএনজি, থ্রিহইলার, পিকাপ, ভ্যান, ট্রাক, বাস, অটোরিক্সাসহ পরিবহন বেড়ে চলেছে। দেশের যে কোন স্থানের রাস্তাঘাট স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত পরিবহনজনিত যানজট সৃষ্টি করছে। দ্রুত নির্দিষ্ট গন্তব্যে ছুটে চলার বর্তমান তরুণ প্রজন্মের একমাত্র বাহন মোটরসাইকেল জনিত দুর্ঘটনার সংখ্যাও দিন-দিন বেড়েই চলছে। শুধু মহাসড়কেই নয়, মহল্লা ও অলিগলিতে মেট্টোরেলের গতিতে টিনএজার বাইকারদের বাইক শো- ডাউনের দিকেও অভিভাবক ও ট্রাফিক পুলিশকে এগিয়ে আসতে হবে। নিয়ম নীতি ও  আইনের কঠোরতার প্রতি ওদের সচেতন করতে হবে। এছাড়াও অবাধে ও অবৈধ পন্থায় লাইসেন্স প্রাপ্তী, পেশাগত ট্যাগ লাগিয়ে গাড়ি, বাইকের যে বাহাদুরি নিয়ে চালকরা যার যেভাবে খুশি বাহন চালাচ্ছে, এসব বিষয়ও আমলে আনতে হবে। নিতে হবে কঠোরতা। সারা বাংলাদেশের বড় রাস্তা কি ছোট রাস্তা, পাড়া কি- মহল্লা, কোন রাস্তাঘাটকেই এখন আর নিরাপদ মনে হয় না। ঘর থেকে বেরিয়ে স্কুল কলেজ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কায়কারবার করা, চাকুরিজীবি, শিক্ষক চিকিৎসক প্রশাসনের কারও জীবনই এখন নিরাপদ নয়। সবাই কি আমরা  ঝুঁকিমুক্ত সড়কের পথচারী ?

শ্যামপুরে ট্রাকচাপায় মারা গেল একজন দিনমুজুর, রেইলিরোডে কাল মারা গেল রিক্সাচালক তাজুল ইসলাম, পরশু হাজারীবাগ বেড়িবাঁধে পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় মারা গেল গৃহবধু নূরজাহান, একই দিনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক মৃত্যুটি ছিল নর্দান ইউনিভার্সিটির ছাত্রী নাদিয়া আক্তারের। প্রগতি সরণিতে সদ্য ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া ছাত্রীর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিলো- দানব ‘ভিক্টর পরিবহন । বন্ধুর মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ছিলো নাদিয়া। ঢাকা শহর যে মোটর সাইকেল চলাচলের জন্য নিরাপদ নয়, বিশেষ করে ব্যস্ত সড়ক, মহাসড়কগুলো- এটা এখন স্পষ্টই প্রমাণিত। শুধু আমরা যাত্রী সাধারণই যেন বুঝতে অক্ষম। গত কয়েকদিন সড়কে মৃত্যুর দুঃসংবাদ ঢাকার বাইরেও ছিল খুব ভয়াবহ। গোপালগঞ্জে ট্রাক চাপায় মারা যায় ভ্যানচালক, একই এলাকায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় মারা যায় এক পথচারী, নাটোরের লালপুরে সিএনজি আর অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যায় আমিরুল আর আসলাম, লক্ষীপুরে ট্রাকের চাকায় চলে যায় কিশোর আজিম, সুনামগঞ্জে ইটবোঝাই ট্রলিতে মারা যায় শিশু সায়েম, নওগাঁয় বাসের ধাক্কায় মারা যায় মোটরসাইকেল আরোহী হারুনুর রশিদ, বগুড়ায় পিকাপ আর বিদ্যুতের খুটির সংঘর্ষে মারা যায় পথচারী খাইরুল, পিরোজপুরে বাস চাপা দেয় রিজিয়া বেগমকে, ফরিদপুর ভাঙ্গায় পিকাপ আর প্রাইভেট কারের সংঘর্ষে মারা যায় যাত্রী আল আজাদী, হাতীবান্ধায় ট্রাকের চাকায় মারা যায় ব্যাংক কর্মকর্তা লতিফুল, নান্দাইলে ইজিবাইক ও  মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে মারা যায় শিক্ষক সিরাজ উদ্দিন, মেহেরপুরে শিক্ষিকা শামিমা ইসলাম মারা যায় ট্রাকের চাপায়। শায়েস্তাগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় এই কয়দিন আগে- মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ড্রাইভার সাতির আলীসহ একই পরিবারের মারা যায় ৪ জন। একই থানায় রবিরবাজারে থ্রিহইলার অটো দুর্ঘটনায় মারা যায় মা আসমা ও তার শিশু সন্তান সাঈদ। অবাক করা বিষয়, পরিবহনকে সামাল দেয়ায় নিয়োজিত ট্রাফিক-পুলিশ, এমনকি ভলেন্টিয়ারও আজ ব্যস্ত সড়কে নিরাপত্তাহীন। এমনই একটি নজীর; গাজিপুর চন্দ্রায় সড়কে ডিউটিরত আজাদুল। যাকে ২১ জানুয়ারি সকালে একটি  ট্রাক চাপা দিয়ে যায়। আর  সারা বাংলাদেশে হয়ত আরও অনেক আহত নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে সবার অজান্তে।

চলতি মাসের এই কয়দিনের পরিসংখ্যানে- এতগুলো মানুষ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে। বিষয়টা খুব মর্মান্তিক। হৃদয়-বিদারক। বেপরোয়া চালকদের চিহ্নিত করতে না পারলে, দোষী চালক, হেল্পার ও পরিবহন মালিকদের প্রতি কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে, সড়কে প্রাণহানীর মত এই শোকগাঁথার ক্রন্দন আর কোনদিনও বন্ধ হবে না। ট্রাফিক-পুলিশ-সার্জেন্টদেরও আরও উন্নত প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতার সাথে দায়িত্বপালনে উদ্ধুদ্ব করতে হবে। সেই সাথে, নাগরিক জীবনেও সচেতনতাবোধ সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হবে গুণীসমাজকে। প্রশাসন যদি এখনই বিষয়টা নিয়ে কাজ না করে। সড়ক দূর্ঘটনারোধে মেধাবী ও  দক্ষ নগর-বিজ্ঞানীদের সরনাপন্ন না হন, পরামর্শ গ্রহণ না করেন, মেট্টোরেল নিয়ে আমরা যতই আনন্দ উৎসব করি না কেন, বিশ্বের দরবারে কিন্তু আমরা- ‘সড়কে লাশের দেশের তালিকায় প্রথম স্থান’ সমৃদ্ধ জাতি হিসেবেই বিবেচিত হবো।

ছবি : সংগ্রহীত (ইন্টারনেট থেকে)

মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি