৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ / ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ২৭শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি / রাত ১২:৫৮

তীব্র গ্যাস সংকটে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা, বিপাকে গৃহিনীরা

ভর্তুকি কমাতে গ্যাসের দাম বাড়ে।কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া শুরু হয় শিল্পখাত থেকে শুরু করে,গৃহিনীদের হেসেলে হেসেলে। এটাই এখন বাস্তবতা।এটাই এখন ঢাকা শহরের প্রায় এলাকার একটি নিত্য দিনের প্রতিচিত্র। চুলায় আগুন নাই মানেই গৃহিনীদের বুকের আগুনও যেন ছ্যাত করে উঠছে !

গ্যাসের চুলায় আগুন দিলেও চুলা জ্বলছে না। মেন লাইনে গ্যাস সরবরাহের ঘাটতিতেই মূলতঃ এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রায় গেল বছর থেকেই এই ভয়াবহ সমস্যাটা আরও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। শহরের অনেক ঘরবাড়িতেই বৈধ সংযোগ থাকার পরও সকাল থেকে চুলায় গ্যাস পাওয়া যায় না। রাতে কিংবা ভোরেও অঘুমো থেকে রান্নাবান্না করতে হচ্ছে অনেক মা বোনদের। ভোরে একটু গ্যাস থাকে। সাড়ে ছয়টায় যে গ্যাস যায়। আসতে আসতে সবার সকাল দুপুরের রান্নার সময় খতম ! দুপুরে কি বিকেলে একটু ঢিমা আগুন আসে। তবু একটা ডিম ভেজে খাওয়ার উপযোগি আগুন বলা যায় না। বলা চলে, এক প্রকার বিপাকেই আছেন গৃহিনীরা। সন্তানদের স্কুল  কলেজ, স্বামীদের ব্যবসা-চাকুরিতে যেতে রান্না করে খাওয়ানোর যে দায়িত্ব, সেটা ব্যহত হচ্ছে পুরোপুরি। এছাড়াও বাড়িতে মুরুব্বি বাবা মা, কারওবা শশুর শাশুড়িকেও দেখভাল করতে হয়। খাওয়া দাওয়া রান্নার আয়োজন করতে হয়। রান্নার জন্য যদি চুলোতে আগুনই দেয়া না যায়, তাহলে প্রতিটি পরিবারের কি যে ভোগান্তি। আহাজারি। হতাশা। সেটা শুধু হাতে দা বটি খুনতে নিয়ে হেসেল সামলানো নারী জাতিই বলতে পারবেন। বিষয়টি খুব দুঃখজনকও বটে !

অনেকের বাড়িতে যাদের বৈধ্য সংযোগ নেই। কিংবা বহুতল ভবন। এরা এলপি গ্যাস দিয়েই মূলতঃ রান্না করছেন। ব্যতিক্রম শুধু বৈধ সংযোগ সম্পুন্ন বাসা বাড়িগুলো। অনেকেই এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ভয়ে বিকল্প হিসেবেও এলপি গ্যাস ব্যবহারের পক্ষপাতি নন। তবে ইদানিং বৈধ সংযোগধারী কিছু পরিবার চুলোয় গ্যাস না পাওয়ায়, বিরক্ত হয়েই, এলপি গ্যাস ব্যবহার করা শুরু করেছে। আবার কেউ কেউ এলপিজির থেকে কম খরচের আশায়, আর একটু কম খরচে বিদ্যুত বিলে দিয়েও চাইছে, আধুনিক বৈদ্যুতিক চুলা বা ইনডাকশন ওভেন দিয়ে রান্নার কাজ সারতে। তবে দুঃখজনক হলেও চিরসত্যি, প্রতিবেদনের ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন, ছাদে ইটের চুলো তৈরি করেও গৃহিনীরা কিভাবে পরিবারের আহারের ব্যবস্থা করছেন। অনেকে আবার ২০০ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকা খরচ করেও শহর ছেড়ে দুর গ্রাম থেকে মাটির চুলো কিনে আনছেন। ফ্লাট বাড়ি, দালান কোঠা, বহুতল ভবনে এমন মাটির চুলোয় রান্নার দৃশ্যটা কারও কাছে মজার ও আনন্দদায়ক হলেও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য কিন্তু এটি একটি হতাশার খবর। অপমানজক উদাহরণ। পাশে গ্যাসের চুলা। কিন্তু রান্না করতে হচ্ছে আমাদের মাটির চুলায়? সবকিছুর মূলই হচ্ছে দেশের তীব্র গ্যাস সংকট। রাজধানীতে বসবাসকারীদের যা অন্যতম একটি প্রধান সমস্যা। ২০২২ সালের অনলাইন রিপোর্টে গ্যাস সংকটের কারণ হিসেবে আমরা দেখেছি; শহরের বিভিন্ন এলাকায়- ‘তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের’১৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি গ্যাস সরবরাহ করেছে ১৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। স্বাভাবিকভাবেই গ্যাসের ঘাটতি দেখা গেছে ৩০ কোটি ঘনফুট। দেশের অন্যান্য অবকাঠামো মিলিয়ে এই মুহূর্তের গ্যাস সংকট প্রায় ১০০ কোটি ঘনফুট। সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্টোবাংলা) ’র সূত্র মতে প্রতি বছর বাসা-বাড়িতে ব্যবহার হয় গড়ে ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ গ্যাস। যা দেশের মোট অবকাঠামোতে ব্যবহার্য  ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিএসএফ) বা ১০০ বিলিয়ন ঘনফুট (বিএসএফ) থেকে ১ দশমিক ১ টিসিএফ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উৎপাদন কমে যাওয়া (ডিপলেটিং ফিল্ড ) গ্যাস ফিল্ড গভীর খনন (ডিপ ড্রিলিং) এর কোন বিকল্প নেই। কূপ খনন ও স্থলভাগে দ্রুত এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ ও জ্বালানি নিরাপত্তা রক্ষাও হতে পারে এর আশু সমাধান। তবে, অনেকে মনে করেন, গ্যাস সংকট তৈরি করে এলএনজি আমদানিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আলোচনা সমালোচনা উর্দ্ধে সমাধানই আসলে এই মুহূর্তে নগরজীবনে বেশি প্রয়োজন। দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল অনুসন্ধান ও সঠিক উত্তোলন নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, আমদানীকৃত গ্যাস দিয়ে দেশের ঘাটতি মোকাবিলা করলে সরকারকে যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে হবে, তার প্রতিক্রিয়া দেশের অভ্যন্তরেই পড়বে। এবং গ্যাসের দাম শুধু বাড়তেই থাকবে। যেমনটা এখন গ্যাস ব্যবহারকারীকেই বহন করতে হচ্ছে। আবাসিকে গ্যাস সংকটের এই কঠিন সময়ে গৃহস্থালির জ্বালানির প্রধান বিকল্প হিসেবে সে কারণে- পেট্টোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ই একমাত্র ভরসা। আর এলপিজি ব্যবহার শুধু সহজলভ্য করলেই কাজ হবে না। ন্যায্য মূল্যে বা সুলভে গ্রাহককে এলপিজি সেবা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অবৈধ গ্যাস সংযোগের লুকুচুরি দুনীর্তিও একটি ভয়াবহ সমস্যা। ক্যাভটিভ পাওয়ার স্টেশনে গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে, দেশের আনাচে কানাচে অবৈধ লাইনে গ্যাস সংযোগও চিহ্নিত করা জরুরি। বৈধ সংযোগের সুযোগ নাই বলে যেই প্রতারণায় অবৈধ সংযোগ চলছে। খুব দ্রুত এসব সংযোগও বিচ্ছিন্ন করার আদেশ জারি করতে হবে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আবাসিক এলাকায় ৫৬ হাজার আবেদনকারী ‘নতুন গ্যাস সংযোগের’ জন্য তিতাস বরাবর ডিমান্ড নোট জমা দেয়। যদিও ২১ মে ২০১৯  সাল থেকেই সরকারি অধ্যাদেশে ‘কোন গ্যাস সংযোগ না দেওয়ার’প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। এবং বলা হয়েছিল – ভবিষ্যতে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি হলে নতুন গ্যাস সংযোগ বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে এসে আমরা কি পেলাম ?  

রাজধানীবাসী চুলায় গ্যাস পাক কি না পাক – থেমে নেই গ্যাসের এই লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধির ‘ঘোড়দৌড়’! পেট্টোবাংলা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে গেছে। যে কারণে স্পর্ট মার্কেট থেকে চড়া দামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এজন্যই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিইআরসি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটিও দাম বৃদ্ধির পক্ষে মত প্রদান করে। বিইআরসি জানিয়েছে ভোক্তা পর্যায়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ঘনমিটারে ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২২.৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১১.৯১ টাকা করা হয়েছে। গেল বছর জুন থেকে বাসা বাড়িতে গ্যাস ব্যবহারে এক চুলায় ৯৯০ টাকা ও দুই চুলায় ১ হাজার ৮০ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। নতুন বছর শুরুতেই আবার সেই একই কাহিনী ! ১৮ জানুয়ারি, জ্বালানি বিভাগের জারিকৃত নির্বাহী একটি আদেশ প্রকাশিত হয়। প্রজ্ঞাপনে গ্যাসের নতুন মূল্য আবাসিক খাতে পূর্বের ন্যয় স্থিতিশীল থাকলেও ক্যাভটিভ পাওয়ারসহ ৬টি খাতে ঠিকই গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৪ থেকে ১৭৮ শতাংশ। এই একই দিনেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা সংসদ অধিবেশনেও গ্যাস বিষয়ক গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি প্রশ্নও উত্থাপন করেছেন।

‘‘পৃথিবীর কোন দেশ গ্যাস আর বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়?”

দেশের আপামর জনগণ যেখানে নাগরিক সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছে। হঠাৎ করে আমাদের সুস্থ সুন্দর জীবন যাপনে ব্যত্যয় ঘটলে কিছুটা হলেও মানুষ তো একটু বিচলিত হবেই। দেশের নাগরিক সমাজ মানবিক অধিকারের প্রত্যাশাতেই সন্তুষ্ট রবে। কিন্তু সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিক সম্পদ মন্ত্রণালয়কে তো আর হাত পা গুটিয়ে থাকলে চলবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উক্তিটি খন্ডানোই যেন এখন তাদের জন্য হয়ে পড়ল, একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিদ্যুত হোক আর গ্যাস হোক। জনগণের ব্যবহারে সবকিছু সহজলভ্য করার ওপরই এখন সরকারের ভাবমূর্তি নির্ভরশীল। সে কথা বলাই যায়। 

মারুফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি